Galpo ---- আই লাভ ইউ
(ছোটগল্প)
আই লাভ ইউ
শ্যামল সরকার
মুখে হাসি ফুটল মৃনালিনীর । দিনের প্রথম হাসি ওর এটাই । উদ্যানের ঘাসের উপর কী যেন
খুঁজে পেয়েছে হঠাৎ । যা
পেয়েছে তাই যেন খুঁজছিল সকালের শিশির ভেজা ঘাসে
দীর্ঘক্ষণ ধরে । দু’হাত অঞ্জলি করে ঘাসের
বুক থেকে ধীরে ধীরে তুলল সে খুঁজে
পাওয়া মহার্ঘ্য ধন পরম যত্নে । পরনের
ছেঁড়া শাড়ীর খুঁটে বাঁধল শক্ত করে । সত্তরোর্ধ
অরুনাংশুবাবু দেখতে
পেয়ে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন ---- কী পেলি রে ওখানে ? ছুটে পালাচ্ছিস কেন
? বল, কী পেয়েছিস ? ময়লা বেশবাস, ভবঘুরের চেহারার মৃনালিনী আর দাঁড়াল না । দৌড়ে পালিয়ে যেতে
যেতে কেবল বলল --- কয়টি শব্দ পেলাম গো, প্রিয়তম শব্দ ।
বসুন্ধরা
সিটির এই উদ্যানটি ভোর পাঁচটায় খুলে যায় প্রতিদিন । বেলা আটটা পর্যন্ত মর্নিং
ওয়াকারদের জন্য ফ্রি এন্ট্রি, আটটার পর থেকে প্রবেশমূল্য দশ টাকা জনপ্রতি । আটটা পর্যন্ত প্রচুর মানুষ
হাঁটতে আসেন । আটটার পর থেকে দিনভর বাগানের গাছ গাছালির আড়ালে আবডালে প্রেমিক
প্রেমিকাদের ফিসফিস, ভালবাসার শব্দ বিনিময় আর নিরিবিলি সময় যাপন । বোর্ড দিয়ে অনেক বিধি
নিষেধ বিজ্ঞাপিত করা আছে উদ্যানে, কিন্তু সেসব মানে না কেউ । মানানোর বেয়ারা চেষ্টাও
করে না কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে । বাগানের অফুরান ফুলের সৌরভের মতো উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের
প্রেমালাপের মনোরম শব্দপুঞ্জ দিনভর ছড়িয়ে পড়তে থাকে উদ্যানময় । আশেপাশেই দু’তিনটি স্কুল-কলেজ । ছেলেমেয়ের অভাব নেই । ক্লাস কেটে ওরা যেন উড়তে উড়তে আসে রঙিন
প্রজাপতির মতো । বাগানের শোভাবর্ধন করে । বিকেলের দিকে ভিড় আরও বাড়ে । সন্ধ্যার আলোআধারিতে ভালবাসা গাঢ়তর
হয় । মোহময় চাঁদের আলো আর নিঃশব্দ সীৎকারে ভরে ওঠে পুরো উদ্যান চত্বর । বাগানের বাইরে থেকে প্রাচীরের
তারজালির ভেতর দিয়ে কিছু ক্ষুধার্ত চোখ
চেয়ে থাকে বাগানের ভেতর দিকে রাত্রি আটটায় বাগান বন্ধ হওয়া পর্যন্ত । কী যেন খোজে চোখগুলি । রাত্রির অস্পষ্টতায় কিছুই দৃশ্য নয় । তবু চোখ গুলো স্থির হয়ে থাকে ভালবাসার অন্দরমহলে ।
অরুনাংশুবাবু অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক । সরকারী হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন ।
ভেবেছিলেন অবসরের পর প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন । কিন্তু অবসরের প্রায় সাথে সাথেই
হঠাৎ মৃত্যু হয় স্ত্রী অপরূপার । মেয়ের বিয়ে হয়েছিল আগেই । সে স্বামীর সাথে বিদেশে
সেটল্ড । অধ্যাপনা আর গবেষণার কাজে বেজায় ব্যস্ত । বহুদিন আসে না । মাঝে মাঝে ওর
টেলিফোন আসে শুধু । নিয়মরক্ষার কথা । দিন তিনেক আগেই নাতিটার জন্মদিন ছিল । টেলিফোন করেছিলেন অরুনাংশু ।
---- হ্যাপি বার্থ ডে মাই ব্রাদার ।
---- থাঙ্কু গ্র্যান্ড ।
---- কেমন আছ তোমরা ?
------ ফাইন দাদু । তুমি
?
----- আমিও ফাইন ।
স্কুল পড়ুয়া ছেলে মাকে টেলিফোন ধরিয়ে দিল । এপার থেকে বুঝল অরুনাংশু
-- বুড়োর সাথে কথা বলে বোর হচ্ছিল নাতি । মনের
উপর হঠাৎ নেমে আসা এক খণ্ড মনখারাপের কালো
মেঘকে দু’হাতে সরিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করল বৃদ্ধ অরুনাংশু
---- কেমন আছিস মা ?
----- ভাল আছি বাবা ।
তুমি ঠিক আছ ? ঔষধগুলো ঠিকমতো খাও ?
----- হ্যাঁ ।
------ ভাল থেকো বাবা
।
অরুনাংশুবাবু চুপ । ওপার থেকেও আর কোন কথা আসছে না । তিনি বুঝলেন তাদের কথা শেষ হয়ে গেছে । কেউ আর
শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না । টেলিফোন কাটলেন । বসে পড়লেন বারান্দার ইজিচেয়ারে । সামনে
খোলা মাঠ । একরাশ শূন্যতা ছড়িয়ে আছে মাঠজুড়ে । চারপাশে ঘন নীরবতা । এদিকটায় যেন পাখিরাও ডুবে
থাকে মৌনতায় । অরুনাংশুবাবু ভাবেন --- এত শব্দ সংকট কেন ? চারপাশে কী কেউ নেই, যে
অন্তত মিথ্যে করে হলেও বলবে ---- আমি তোমাকে ভালবাসি ।
অরুনাংশুবাবুর বয়স আশি
পেরিয়েছে । তবু নিয়মানুবর্তিতা আর সুঠাম
গড়নের জন্য এখনো শরীর যথেষ্ট শক্তপোক্ত ।
প্রতিদিন সকাল ছ’টায় হাঁটতে আসেন
উদ্যানে । পাক্কা আধ ঘণ্টা পায়চারি করেন । তার পর উদ্যানের কংক্রিটের
বেঞ্চে বসে বিশ্রাম করেন । সকালের নরম রোদ থেকে শরীর সেঁকে সেঁকে ভিটামিন ডি নিংড়ে
নেন । ওখানে বসেই মোবাইল চা-ওয়ালা চরণের হাতের এক কাপ লিকার চা পান করে সাতটা
নাগাদ বাড়ী ফেরেন । কাজের লোকের হাতে যেভাবে প্রবীণ মানুষরা বলি হচ্ছেন আজকাল
চারদিকে, তিনি কোন লোক রাখেন নি বাড়ীতে । হোটেল থেকে খাবার দিয়ে যায় দুবেলা,
ওয়াসার ম্যান কাপড়চোপড় ধুয়ে দিয়ে যায় । বাকী কাজকর্ম নিজেই করে নেন । তিনি বোঝেন, তার সব আছে, কেবল অভাব শব্দের । অপরূপার ড্রেসিং টেবিলের ঢাওস আয়নার সামনে
দাঁড়িয়ে নিজের সাথে কথা বলা ছাড়া আর কেউ নেই কথা বলার । তার এককালের সহপাঠী
ডাক্তার অরণ্য সেনের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয় সকালের উদ্যানে । তার শরীর ভাল নেই ।
তবু প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছে । ডাঃ সেন সেদিন দেখা হতেই বলেছিল --- জানিস অরুণ,
মনের ডাক্তারদের দেখলে আমার মনে হয় তারা নিজেরাই এক এক জন মনরোগী । অরুনাংশু
বন্ধুর কথাটাকে রসিকতা হিসেবেই নিয়েছিলেন । হেসে বলেছেন ---- মনরোগী তো আমরা সবাই
বন্ধু । কথা আর এগোয় নি । ডাঃ সেন চলে গেছেন ধীরে ধীরে যেভাবে সময় চলে যায় নিজস্ব
গতিতে ।
আজ অরুনাংশুর চোখ এড়ায় নি মৃনালিনীর প্রাপ্তিযোগ । অরুনাংশু মৃনালিনীকে
চেনে । তার মতই মৃনালিনীও উদ্যানের নিত্য প্রভাতচারিনী । এই উদ্যানে যারা নিয়মিত
মর্নিং ওয়াকে আসে, প্রত্যেকে প্রত্যেকের চেনা, অন্তত মুখচেনা । প্রত্যেকের সাথে
প্রত্যেকের বাক্য বিনিময় না হলেও, একচিলতে স্মিত হাসির বিনিময় হয় পাশ কাটিয়ে যাবার
সময় । মৃনালিনীর চেহারা, বেশভূষা কিছুই ভদ্রলোকের মতো নয় । বরং চেহারায় দারিদ্র
এবং কিছু অস্বাভাবিক মানসিকতার ছাপ স্পষ্ট
। প্রতিদিন বাগানে এসে কী যেন খুঁজতে থাকে । কোনদিন তাকে কিছু খুঁজে পেতে দেখে নি অরুনাংশু
। আজই প্রথম নজরে পড়ল --- মুল্যবান কিছু
একটা খুঁজে পেয়ে সটান হাঁটা দিয়েছে
উর্ধশ্বাসে । পিছু নিল অরুনাংশু । ডাকছে ----- কী পেলি, দেখিয়ে যা রে মেয়ে ।
কিন্তু প্রবীণ মানুষটির নাগালের বাইরে চলে গেল বছর পয়ত্রিশ-চল্লিশের মৃনালিনী চোখের নিমেষে ।
পরদিন সকালে মৃনালিনী নিজেই
এসে দাঁড়াল অরুণাংশুবাবুর সামনে । মাথা নিচু । অবাক হয়ে দেখলেন তিনি
মেয়েটির ভেতর গতকালের উচ্ছাস আর নেই ।
বরং তাকে ছেয়ে আছে একটা গভীর বিষণ্ণতা । জিজ্ঞেস
করলেন ----- কী হয়েছে তোর ? দুপাশে মাথা
নাড়তে নাড়তে মুখ তুলল সে ।
ভাল করে তাকিয়ে দেখলেন,
তার দু’চোখের তলায় কালি পড়েছে গভীর ভাবে । প্রবলভাবে চোখে মুখে ডিপ্রেশনের
লক্ষণ । গলা
নরম করে আদুরে গলায় অরুণাংশুবাবু জিজ্ঞেস করলেন এবার
---- বলো, কী হয়েছে তোমার ?
তীব্র মনকষ্টে ভাঙচুর হতে হতে উত্তর দিল সে -----
আমার সব হারিয়ে গেছে ?
----- সব কী ? গতকাল কী
খুঁজে পেয়েছিলে ?
----- এখানে সারাদিন এত ভালবাসার কথা হয় । প্রতিদিন খুঁজি যদি এক-দুটি কথা কেউ ভুল করে ফেলে যায় ।
----- গতকাল পেয়েছিলে ?
------ হুম । কী সুন্দর
! হীরের টুকরোর মতো ঝলমলে
তিনটে স্বপ্নিল শব্দ ---- আই লাভ ইউ ।
------ কী হল তারপর ?
------ তুমি ডাকলে, আমি
ওগুলো নিয়ে পালিয়ে গেলাম ।
কিন্তু তারপর কোথায় যে হারিয়ে গেল,
আর খুঁজে পেলাম না । শিশুর সরলতা নিয়ে এবার
সরাসরি জিজ্ঞেস করল অরুণাংশুবাবুকে ---- আচ্ছা, তুমি
পেয়েছ ওগুলো ?
অরুণাংশুবাবু দু’চোখ মেলে তাকিয়ে আছে মেয়েটির
দিকে । অবাক চোখে দেখছে ---- মৃনালিনীর চোখে মুখে লেগে আছে অতি সহজ-সুন্দর কৌতূহল ।
সারা শরীরে দারিদ্র আর অবহেলার ছাপ । চালচুলোহীন । আবার বলল সে ---- সত্যি করে বল না, আছে তোমার কাছে ?
অরুণাংশুবাবুর চোখে ধরা পড়ল তখন ওর দ্বিমুখী
আচরণ । একই মানুষ তীব্র বিষণ্ণতায় আক্রান্ত, অন্যদিকে তার ভেতরই কিছু একটা
প্রাপ্তির খুশিতে অতিরিক্ত উচ্ছাস । মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে বেরিয়ে এল অরুণাংশুবাবুর
--- দ্বিমুখী আচরণ বৈকল্য । কগনিটিভ
বিহ্যাবিয়ারল থেরাপি আর ফ্যামিলি
থেরাপি প্রয়োজন ।
এতক্ষণ খেয়াল করে নি অরুণাংশু, পাশে দাঁড়িয়ে
ডঃ সেন । বললেন ---- দীর্ঘদিন প্র্যাকটিস করছ না, কিন্তু তোমার ডায়গনোসিস একদম ঠিক
অরুণ । ইটস অ্যা কেস অব বাই-পোলার মুড ডিজর্ডার । বলতে বলতে হেলেদুলে চলে
গেল ডঃ সেন ।
তাড়া দিল মৃনালিনী
---- কী হল ! কথা বলছ না কেন ? পেয়েছ তুমি ।
ওটা আমার খুব প্রয়োজন গো । জীবন মরণ সমস্যা । কতকাল আগে একজন দিতে চেয়েছিল, ঠিক
এখানেই । নিতে পারি নি । আর
তার পর থেকে এত খুঁজছি কিছুতেই পাচ্ছি না ।
কী যেন মনে হল অরুণাংশুবাবুর,
বললেন ---- চলো, আমার কাছে
আছে, অনেক আছে । অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে । চলো আমার সাথে । মেয়েটি যেন উচ্ছাসে ফেটে
পড়ল ---- আছে ! এক্কেবারে
সামনে সরে এসে বলল ------ একটু দেখাও দেখি ? অরুণাংশুবাবু দু’হাত বাড়িয়ে ওর দু’গালে হাত রেখে বলল আমার সাথে চল মা, আমি
বড়ো একা ---- আই লাভ ইউ । ঠিক তক্ষুণি হাজার হাজার পাখীর মিষ্টি কলরবে ভেসে গেল বসুন্ধরার আকাশ বাতাস ।
-----শেষ-----
Comments
Post a Comment