ছোটগল্প ------ তেঁতুলতলার চারজন ও অন্যরা
(ছোটগল্প)
তেঁতুলতলার চারজন ও অন্যরা
শ্যামল সরকার
‘দায়িত্বে থাকবেন, অথচ দূরে সরে সরে থাকবেন ---- এটা তো হতে পারে না’
----- বেশ বিরক্তির সাথে কথাগুলো বলল সৌমেন । বরাবরের মজার মানুষ হরিহর একথা শুনে এক ধাক্কায় এক্কেবারে নিভিয়ে দিল ভ্রাতৃসম বন্ধু সৌমেনকে -----
‘কী যে বলিস ভাই, এ ব্যাপারে তুই আসল লোকটাকে ধরছিস না কেন ? স্বয়ং ঈশ্বর তো এই কায়দাতেই দুনিয়া সামলাচ্ছে । নিজে সব, অথচ নিজেই অধরা ।’ ‘হুম, কথাটা কিন্তু মোক্ষম বলেছ হরিদা, একদম ন্যায্য কথা’ ---- মুখ ভরে সাপোর্ট দিল হরিহরকে ঠেকের অন্যতম মুখচোরা সদস্য সদানন্দ । সে বলল
আবার ---- ‘ভগবান নামের অহংকারী ভদ্রলোক জামার কলার
তুলে দাবী করেছেন ভাগবত গীতার পাতা ভরে ---- ‘আমিই সব । অথচ দ্যাখো, ভদ্রলোকের টিকিটিরও দেখা নেই ।’ হরিহর সদানন্দর কথার রেশ ধরে উচ্চারণ করল ---- ‘অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে ।’ সদানন্দ আবদার করল ---
একটু মানেটা বুঝিয়ে বল না হরিদা । হরি বলছে এ কথার মধ্য দিয়ে ভগবান দাবী করছেন ---- ‘আমিই জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস । জগতের সব কিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয় ।’ তার পরই খুক খুক কাশতে কাশতে পুরানো কথার খেই ধরে বলল হরিহর ---- ‘ভগবান নিজেই দাবী করছেন, তিনিই সব, অথচ তিনি নিজেকে অধরা করে রেখেছেন । এটা
মেনে নেওয়া যায় ?’ সৌমেন হরিহরের হাত থেকে সিলিমটা টেনে নিয়ে
একটা মোক্ষম টান দিতে দিতে বলল ----
‘এটাই তো আমার বক্তব্য । তোমাকে আর আমাদের শ্রীযুক্ত ভগবানকে নিয়ে আমাদের একই
প্রব্লেম হরিদা ৷' হরিহর বিজ্ঞের মতো বলল ---- 'এটা কিন্তু ঠিক নয় । ভগবান নামের ভদ্রলোক
কিন্তু এক্কেবারে এক্সট্রিম কেয়ারলেস । আমি কী এমন কখনো হতে পারি !' সদানন্দ এবারও সাপোর্ট দিল তার প্রিয়
হরিদা কে ----- ‘নাহ, হরি দা কে কিন্তু
ঈশ্বরের সাথে তুলনা করলে অন্যায় করা হবে ।’ সৌমেন বেশ জুত করে একটা টান
দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল ----
'আমাদের আন্দোলনে নামতে হবে ৷' ভদ্রলোকের বেয়াদপি আর সহ্য করা যায় না ।
সদানন্দ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল ----
'কার ?' সৌমেন চোখ পিট পিট করে হরিহরের দিকে
জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছুড়ে বলল ----
'কার কথা বলছিলাম যেন হরি দা ?' ততক্ষণে সিলিমটা হরির ঠোঁট
ছুঁয়ে ফেলেছে । সে একটা জোর টান দিয়ে কাশতে কাশতে ধ্বনি দিল উচ্চ কণ্ঠে ---- ‘জয় শিব শম্ভু ।’
প্রতি রাতে গাঁজার আসর বসে তেঁতুলতলার শ্মশান ঘাটে । এই চত্বরে কোন বাড়ী-ঘর নেই । এক চিলতে মরা নদীকে পাশে নিয়ে গ্রামের এক কোণে দিনভর একা পড়ে থাকে তেঁতুলতলার শ্মশানঘাট । এই ঘাটে মৃতদেহ ইদানীং বেশী আসে না । কেবল অনেকটা রাত্রি যখন বাড়ে ায়ে এসে হাজির হয় কয়েকটা সৌমেন---- ছায়া মূর্তি, হরিহর, সদানন্দ আর ল্যাংড়া নন্দলাল । এদিক সেদিক ঘুর ঘুর করতে থাকে কটি ক্ষুধার্ত
শেয়াল, চিৎকার ক’রে একসাথে ডাকতে থাকে হুক্কা হুয়া । দূরের
লোকালয়ে তখন একযোগে ডেকে ওঠে গেরস্ত বাড়ীর অসংখ্য দেশি কুকুর ---- ---- ঘেও ঘেও । নন্দরা চারজন মুখোমুখি গোল হয়ে
বসে, যেন পুব-পশ্চিম–উত্তর–দক্ষিণ চার নিরীহ দিক যুগযুগ থেকে বয়ে
চলেছে প্রকৃতির বহুকালের পুরানো ঐতিয্য । গঞ্জিকার সুগন্ধি ধোঁয়ায় হারাতে থাকে আত্ম ভাবনা । যেন চিরন্তন মহাকালের সাথে তাদের বিলীন হয়ে
যাওয়া জীবদ্দশাতেই ।
সদানন্দ হরিহররা জানে সেখানে তারা ছাড়াও আরও অনেকে আছে । সেখানকার বেশ বড়সড় আড্ডা থেকে একে একে হারিয়ে গেছে সুবিমল, অনন্ত, রিয়াজুল, সনাতনরা । তাদের বিশ্বাস এই শ্মশানেই তারাও আছে অশরীরী হয়ে । এই আনন্দ ধোঁয়ায়
উদ্বেল হয় তাদেরও বায়বীয় অস্তিত্ব । নন্দলাল বলে ---- 'জানিস হরি, আমরা কোনদিন আলাদা হব না । এই জগৎ থেকে
অন্য জগতে পাড়ি দিলেও এখানেই একসাথে কাটিয়ে দেব যুগ যুগ ৷' সদানন্দ সমর্থন করে ---
'তোমাদের ছাড়া আমি যে বাঁচতেই পারব না । সৌমেনের নেশা হলেও শব্দ
নির্বাচনে ত্রুটি হয় না ৷' বলে --- 'বাঁচতে না পারলে ক্ষতি নেই, কিন্তু তোমাদের ছাড়তে পারব না কিছুতেই ৷' হরিহর বলল ---
'সে তো বুঝলাম, কিন্তু রাত যে অনেক হল, বাড়ি যাবি না তোরা ?' নেশা হয়ে যাওয়া সদানন্দ
জিজ্ঞেস করল ---
'কার বাড়ি ? কোন বাড়ী ? বাড়ি বলতে আমরা কী বুঝি ?' নন্দলাল বলল ---- 'বাড়ি হল সেই জায়গা, যেখানে গেলে শান্তি পাওয়া যায় ৷' তক্ষুনি ঘাসের উপর গা এলিয়ে দিল সদানন্দ ।
মুখে বলল ---- 'বেশ, তাহলে এটাই আমার বাড়ি । এখানেই আমি সব
চেয়ে বেশী শান্তি পাই ৷' সৌমেন বলল --- 'হুম, বাড়ী মানেই তো কেবল চাই, চাই । বাড়ির লোকজন বলবে ---
টাকা চাই, বাজার চাই, এটা চাই, ওটা চাই । আর টিভি খুললে ভোট চাই । ওখানে
শুধু বিস্তর চাই-এর ঢাউস চাঁই ৷' সদানন্দ বলল ---
'এখানে কেবল শান্তি ৷' তেঁতুল পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে অফুরান শান্তি
ঝড়ে পড়ে চারপাশে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো । হরিহর ভাবে -----
সংসারে কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবনা । কে কতটা সুখ অধিকার করতে পারে তার
প্রতিযোগিতা চলে দিনভর । কিন্তু এখানে কেবল নিজেকে হারাবার প্রতিযোগিতা । কে কত
তাড়াতাড়ি নিজেকে আত্মভাবনা থেকে মুক্তি দিতে পারে । এসবের মধ্যেই একসময় হরিহরের মনে হল ----
পায়ে পায়ে এসে পাশে বসেছে অনন্ত, রিয়াজুল, সনাতন । ওরা গল্প জুড়েছে কিংবা অবাক হয়ে চেয়ে আছে
শরীরী বন্ধুদের দিকে । মুখে বলল হরিহর ---- ‘আমাকে তোদের সাথে একটু জায়গা দিবি রিয়াজুল
ভাই । এই ইহজগতটাকে এক্কেবারে অসহ্য লাগছে । বল সুবিমল, চুপ করে আছিস কেন ।’ কথা স্পষ্ট হয় না জিভ জড়িয়ে আসে । রাত
গভীর হয় । একসময় উঠে পড়ে ওরা চারজনই । টলতে টলতে রওনা হয় বাড়ীর পথে । পথ হারিয়ে ফেলে ।
আবার যায় । কখনো কখনো বাড়ি পৌঁছতে রাত্ ভোর হয়ে যায় । দিনের আলোয় ভরে ওঠে চারধার ।
তারপর তীব্র ঘৃণায় জবজবে বাড়িতে প্রবল লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মধ্য দিয়ে অযাচিত ভাবে প্রবেশ করে
।
সৌমেন, হরিহর, সদানন্দ আর নন্দলাল প্রত্যেকে একেকজন প্রৌঢ় মানুষ । খুব সাধারণ পরিবার থেকে
আসা ওরা প্রত্যেকে । সৌমেন সরকারী অফিসে ছোটখাটো চাকুরী করত একসময়, এখন পেনশন ভোগী । হরিহর ছিল ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের গৃহশিক্ষক । পেটে বিদ্যে
কিছু আছে তবে এখন আর তার কদর নেই । বেকার হয়ে গেছে এক্কেবারে । সদানন্দ ছিল কোর্টের সামনে টেবিল পেতে বসা টাইপিস্ট । এককালে তার বিস্তর
নামডাক ছিল কোর্ট চত্বরে । ইয়া বড়ো বড়ো দলিলের ড্রাফ্ট ছিল তার ঝড়ের গতিতে চলতে
থাকা আঙুলের ডগায় । কী নির্ভুল আর পরিচ্ছন্ন ছিল তার কাজ । খদ্দেরদের সাথে কথা
বলতে বলতে অবলীলায় ছুটে চলত তার দুহাতের আঙ্গুল শিল্পের মতো । এখন কম্পুটারের
জোরালো আবির্ভাবে এক্কেবারে হঠে গেছে লোহার দাঁত খিঁচানো টাইপমেসিন । সদানন্দর কাজ ফুরিয়ে গেছে । বেকার হয়ে গেছে
এক্কেবারে । নন্দলাল ছিল ট্রেনের হকার । এক মারন এক্সিডেন্টে তার পায়ের
কার্যকারিতা হারিয়ে গেছে । সেও এখন বেকার । চারটে মানুষই পরিবারে, সমাজে ব্রাত্য হয়ে গেছে । জীবনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে ওরা ঠেকেছে গ্রামের
শ্মশানঘাটের তেঁতুল তলার নির্জন ঠেকে, যেখান থেকে মৃত্যু খুব কাছে । হরিহর বলে --- ‘এখানে এলে জীবনের অন্তিম পরিণতি স্পষ্ট দেখা যায় । সিলিমে টান দিলে এক লহমায়
পৌঁছে যাওয়া যায় এক্কেবারে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিস্থলে
।’ সৌমেন বলে ---- ‘পৃথিবীতে একমাত্র আমরাই সেই মানুষ, যারা মৃত্যুকে খুব ভাল চিনি । বন্ধুর মতো
প্রতিদিন আমাদের মৃত্যুর সাথে দেখা হয় । গল্প হয় । মৃত মানুষদের সাথে দীর্ঘ আড্ডা
হয় ।’ নিজেদের বড়ো ভাগ্যবান মনে করে চার প্রবীণ
বন্ধু ।
সেদিন রাত্রিটা বেশ বেড়েছে । আকাশে সোনা রং-এর ঝকঝকে চাঁদ গলগল করে জ্যোৎস্না ঢালছে
চরাচর জুড়ে । সারা শ্মশান জুড়ে তেঁতুল পাতার ফাঁকা দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে
নামছে মনোরম জ্যোৎস্না লোক । সেদিন আর কোন শ্বাপদের দেখা নেই । শীত চলে গেছে কদিন
আগেই । বাতাসে যেন একটা কীসের সুঘ্রাণ । নেশাটাও বেশ চড়েছে । চার
মূর্তি চারদিকে গড়াচ্ছে । সৌমেন জড়ানো স্বরে জিজ্ঞেস করল ---- ‘গন্ধটা কীসের হরিদা ?’ হরি উত্তর দিল চোখ বুজেই ----- ‘মৃত্যুর মনে হচ্ছে ।’ অবাক হল নন্দলাল । জিজ্ঞেস করল ----
‘এত সুন্দর গন্ধ মৃত্যুর !’ উত্তর দিল সৌমেন ----
‘হবে না, এত বড়ো ভিআইপি তিনি, যখন মনে হ্য় আসেন, যাকে খুশি তুলে নেন !’ সৌমেনের কথাটা মনে ধরল
হরিহরের । সে কি যেন বলতে চাইল সে । কিন্তু কথাটা
ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরোবার আগেই গড়িয়ে পড়ে গেল বাতাসে । কেমন যেন একটা ফুঁস শব্দ হল
শুধু । সবাই চুপ করে রইল তারপর অনেকক্ষণ । একসময় নীরবতা ভাঙতে গেল নন্দলাল । কিছু বলার আগেই সৌমেন বাঁধা দিয়ে বলল ----
‘চুপ, কথা নয়, তিনি আসছেন ।’ সবাই চুপ মেরে গেল এক্কেবারে । শিরশির
বাতাস, নিঃশব্দ গাছ, স্মিতহাসি জ্যোৎস্নার মতো চুপ । শ্মশানের সময় এগিয়ে গেল নীরবে ।
Comments
Post a Comment