ছোট গল্প ---- পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ

 

      (ছোটগল্প)

পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ

                         শ্যামল সরকার

     সারাদিন কোন টেলিফোন আসে নি অনিরুদ্ধ নিজেও আর কাউকে কল করে নি আজ রাত্রিবেলা তের তলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে সামনের আলোকময় শহরটার গায়ে চোখ বুলাতে বুলাতে অনিরুদ্ধর মনে পড়ল সে তো সারাদিন আজ একটি শব্দও উচ্চারণ করে নি কিছুই ইচ্ছে করে নি শরীরটা দুদিন থেকে একটু ম্যাজ ম্যাজ করছে গলাটা ভার ভার সময়  না, বাথরুমে গিয়ে দুকলি বাথরুম সং আসে না মনে  আক্ষেপ  হল তার ---- এক লাইন কবিতা যদি পড়া  যেত, কিংবা অন্তত দুলাইন আবৃত্তি একবার তো একটি টিকটিকি এসে ঘরের দেয়ালটা নোংরা করতে পারত, যা দেখে বিরক্ত হয়ে গালাগাল এসে যেত দুচার শব্দ আপনিই আগে যে বাড়িটায় থাকত, বারান্দায় দুটো চড়ুই আসত প্রতিদিন অনিরুদ্ধর মনে হত, একমাত্র এই দুটো প্রাণীই তাকে নিঃস্বার্থ ভালবাসে এই তের তলায় পাখিদের আনাগোনাও মানা করে দিয়েছে কেউ অনিরুদ্ধ ভাবছে ---- নাহ, অফিস না থাকার এই এক জ্বালা টেলিফোনটা হাতে তুলে নিল সে অস্থির ভাবে প্রথমে ডায়াল করল বাড়িতে কেউ ধরল না বয়স্ক বাবা-মায়ের জন্য চিন্তাটা বাড়ল তারপর ডায়াল করল  স্মিতার নম্বরে টেলিফোনটা বেজে বেজে শেষ হয়ে গেলে রিং টোন রিসিভ হল না গত তিন দিনে চার পাঁচ বার রিং করেছে এক বারও সে ধরে নি চিন্তা হল ---- এমন তো হবার কথা নয় উপর দিকে তাকাল অনিরুদ্ধ সামান্য কয়েকটি তারা বিশাল আকাশটাকে আলো দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে অনিরুদ্ধ জানে কিছু পরই আকাশে আধখানা চাঁদ উঠবে হেসে উঠবে তখন আকাশ তারারা চাঁদের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে রাত্রি এগিয়ে যেতে থাকবে আরও গভীর নীরবতার দিকে

     ফ্রিজ খুলে খাবার বের করল অনিরুদ্ধ খেতে ইচ্ছে করছে না তবু খেতে হবেই  মাইক্রোআভেনে গরম করে নিল সেগুলো তারপর ডিনার সেরে ফেলল নিমেষে প্রতিদিন ডিনারের পর মিনিট কুড়ি হাঁটার অভ্যাস তার ঘরের ভেতরেই হাঁটতে শুরু করেছে ইচ্ছে করছে সাউন্ড সিস্টেমটায় বিলায়েত খাঁ চালিয়ে হাঁটতে কিন্তু দিনের শেষে আর শব্দ চায় না সে টিভি সে চালায় না আজকাল ওটা খুললেই এক শ্রেণীর অসভ্য লোকের এত বিশ্রী ঝগড়াঝাটি, চেঁচামিচি  শুরু হয়, কিংবা সারা দেশ জুড়ে যেন মৃত্যুর উৎসবের প্রচার চলে ---- অনিরুদ্ধর অসহ্য লাগে এসব চূড়ান্ত নেগেটিব খবর  আই পি এল শেষ  এখন ক্রিকেট বা ফুটবল চলছে না  কাজেই টিভিটা টানা বিশ্রাম পেয়েছে হাঁটা  শেষ করে ব্যালকনিতে এসে বসল এপ্রিল মাস তবু উত্তরের এই শহরে এখনো তীব্র গরম পড়ে নি বরং রাতের দিকে একটা শীত শীত ভাব লেগে থাকে তের তলার আকাশ ছোঁয়া বাতাসে তখনই টেলিফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ নিস্তব্ধ ঘরে একটা সুরেলা শব্দ ঘরের বাতাস যেন দুলে উঠেছে আলোর মুখে মিটি মিটি হাসি   অনিরুদ্ধ উঠে এল ঘরে টেলিফোনটা হাতে নিয়ে দেখল --- অচেনা নম্বর ইদানিং টেলিফোনে কল করে রাজনৈতিক প্রচার শুরু হয়েছে অনিরুদ্ধর এটাতে ঘোর বিরক্তি টেলিফোনটা রিসিভ করবে কী করবে না ইতস্তত করতে করতেই থেমে গেল তার দামী আই ফোনের সুরেলা রিং টোন না, এবারেও আর কোন কথা বলার প্রয়োজন আর হল না তার নিঃশব্দ বাড়িতে আজ আর জন্ম হল না কোন অর্থ পূর্ণ শব্দের থার্মোফ্লাস্ক থেকে গরম জল নিয়ে গার্গল করে ল্যাপটপটা নিয়ে বিছানায় গেল এ সময় নেট-এর স্পীডটা ভাল থাকে অফিসের সাইটটা খুলল ওয়ার্ক ফ্রম হোমএর এই এক মজা যে কোন সময় টুক টুক করে কাজটা তুলে দিলেই হল সে ইদানীং প্রতি রাতে বিছানায় বসে কাজ করতে করতে এক সময় বিছানায় এলিয়ে পড়ে

     অনিরুদ্ধর ঘুমের সাথে কোন শত্রুতা নেই বিছানায় শুয়ে দুচোখ বুজতেই হুড়মুড়িয়ে তার ঘুম নামে চোখের পাতায় নিমেষে পাড়ি দেয় অন্য জগতে কিন্তু কদিন থেকে ঘুমটা ঠিক ঠাক আসছে না বরং একটা ভয় মনটাকে চেপে ধরছে তার মনে হচ্ছে ---- ঘুম তো  রাতের মতো গভীর নীরবতার এক চিরস্থায়ী রূপ ভয় হয় ---- যদি সে সেই নিরেট নীরবতা থেকে আর ফিরতে না পারে সে তাই  বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে মনটাকে সচেতন রাখতে চেষ্টা করে চোখ বুজে থাকলে শরীর মনের বিশ্রামটা হয়ে যায় আবার চেতনাটা ঘুমের অতলে হারিয়ে যায় না কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে থাকতে পারে না  চোখ বুজে থাকতে থাকতে কখন যে হারিয়ে ফেলে চেতনা, বুঝতেই পারে না

        কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে মানব জীবনে কুড়ি সালের মার্চ থেকে মানুষ কোভিডের হাত থেকে বাঁচতে ঘরের কোণে আশ্রয় নিয়েছিল কত মানুষের কাজ গেছে, সামাজিক জীবন তছনছ হয়েছে, প্রচুর মানুষের প্রাণ গেছে অকালে, ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনা লাটে উঠেছে এত সবের পর নতুন বছর শুরু হলে মানুষ একটু স্বস্তি পেয়েছিল সংক্রমণ উল্লেখ যোগ্য ভাবে কমে আসায় মানুষ একটু একটু করে যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে নির্বাচন শুরু হয়েছে মানুষ অংশ গ্রহণ করেছে কাতারে কাতারে গনতন্ত্রের এই মহান উৎসবে অংশ নিতে এই বেসামাল জন উন্মাদনার সুযোগে তীব্র ভাবে এসেছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এবার এক্কেবারে শেকড় নাড়িয়ে দিয়েছে মানব সভ্যতার লকডাউন, ওয়ার্ক ফ্রম হোম শুরু হয়েছে আবার অফিসে অফিসে অনিরুদ্ধর কোম্পানি জানিয়ে দিয়েছে, আর্থিক অবস্থা ভাল নয় এভাবে বেশিদিন চালানো সম্ভব নয় স্মিতা চলে গেছে নিজের কর্মস্থলে সে দুশো কিলোমিটার দূরে, প্রাইভেট হসপিটালের নার্স কোভিডের প্রকোপ যখন একটু কমেছিল, অনিরুদ্ধ বলেছিল ----- চলো স্মিতা, বিয়েটা করে ফেলি এবার স্মিতা রাজী হয় নি সে তর্ক করেছে ----- কোভিড শেষ হোক, নাহলে যদি আমি শেষ হয়ে যাই ইদানীং সে নাকি আর সময় পায় না যোগাযোগ করার ডিউটির প্রচণ্ড চাপ   অনিরুদ্ধ ভাবে ---- কী এত কাজ স্মিতার ? ডিউটির পরের সময়টায় কী ফোন করা যায় না !  স্মিতা হেসে বলেছে ----- ডিউটির পর বলে এখন আর কিছু নেই

   বিছানায় বসে অনেকক্ষণ একমনে কাজ করল অনিরুদ্ধ বেশ একটা বড়ো কাজ শেষ হতেই মনটা হালকা লাগছে ভাবছে ---- যাক, এবার এটা ক্লায়েন্টকে ডেলিভেরি দেওয়া যাবে মেলটা খুলে বস কে মেল করল ---- ‘প্লিজ ফাইন্ড হিয়ার উইথ দ্যা কমপ্লিট প্রজেক্ট ফর ইয়োর …………তারপর খেয়াল হল ইনবক্স- অনেকগুলো আন রিড মেল পড়ে আছে একটা একটা করে খুলল সে হঠাৎ চোখে পড়ল -----  ফর দ্যা অ্যাকিউট করোনা প্যান্ডামিক ক্রাইসিস কোম্পানি হ্যাজ নো অল্টারনেটিব আদার দ্যান কিপিং দ্যা ওয়ার্কস সাস্পেন্ডেড টিল দ্যা সিচ্যুয়েশণ ডেভেলপস প্লিজ বিয়ার উইথ আজ অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে গেল কাজ তো করছিল ওরা বাড়িতে থেকেই, কোন সমস্যা তো নেই, বরং বাড়ি থেকে কাজ করাতে অফিসিয়াল একসপেন্ডিচার কমে গেছে হাতে প্রচুর অর্ডার, অথচ …… হাত থেকে আচমকা চাকরীটা চলে যাওয়াতে অসহায় বোধ হতে শুরু করেছে বুঝল, এর ভেতরে গভীর ষড়যন্ত্র আছে চোখের সামনে ভেসে উঠেছে একটা নিরেট অন্ধকার মাথাটা এবার ঘুরতে শুরু করেছে চোখ দুটো দিয়ে যেন গরম ভাপ দেশের বাড়ীর কথা মনে পড়ল মায়ের মুখটা, বাবার শীর্ণ শরীরটা, বোনের নির্বাক চেয়ে থাকা কেবল মনে আতঙ্ক হয় ---- এই বুঝি বাড়ি থেকে কিছু খারাপ খবর এল  সে আর শুতে পারল না সারারাত নিজের শরীরে জ্বর বাড়ছে গলা যেন বন্ধ হয়ে বিছানায় শুলে যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে  ব্যালকনিতে এসে বসে আর ঘর বা করতে করতে একটি আস্ত রাত পেরিয়ে গেল নিদ্রাহীন

   সাত সকালে তের তলার বারান্দায় বসে দেখছে অনিরুদ্ধ ---- কী সুন্দর গুছিয়ে দিন হল প্রকৃতিকে দেখে বোঝার উপায় নেই, সে এমন একটি মারন খেলায় মেতে উঠেছে মানুষ মরছে, কর্মহীন হচ্ছে পথ ঘাট শুনশান চারদিকে শান্ত-সুন্দর-ঝলমলে পরিবেশ  মনে হল তার --- মানুষ যত নাস্তানাবুদ হচ্ছে, প্রকৃতি তত সুন্দর হচ্ছে  আবার ফোন করল স্মিতাকে সে ধরল এবার জিজ্ঞেস করল অনিরুদ্ধ ---- তুমি খুব ব্যস্ত ?

----- হুম, হসপিটালে

----- একটু কথা বলা যাবে ?

----- বলো

------- আমার চাকরীটা চলে গেছে

------- মানুষের প্রাণ চলে যাচ্ছে

স্মিতার কথায় বেশ একটা ধাক্কা খেল মনে হল ----- ঠিক তো চার দিকে অগুনতি লোক কোভিডে সংক্রমিত হচ্ছে নিজের শরীরটাও মোটেও ভাল না প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে রোজ অথচ সে এই চাকরী যাবার শোকে পাগল হয়েছে ! তবু নিজেকে সামলে বলল ---- কিন্তু আমার কাছে চাকরীটা চলে যাওয়া যে খুব বড়ো ক্ষতি

অপর প্রান্ত থেকে কোন কথা আর আসছে না একটা শাঁ শাঁ শব্দ ভেসে আসছে যেন কান পাতল অনিরুদ্ধ তারপর বলল --- কীসের শব্দ ওটা ? কীসের ? কথা বলছ না কেন ?

হাঁফ ধরে আসা গলায় বলল স্মিতা ----- তোমার সাথে হয়ত আর দেখা হবে না ভাল থেকো

----- কেন কী হয়েছে ?

কাতরাতে কাতরাতে কোনমতে উত্তর দিল স্মিতা ---- কোভিড  হাসপাতালে অক্সিজেন নেই আর পারছি না

অনিরুদ্ধ আর্তনাদ করে উঠল ---- তুমি অসুস্থ ! বলো নি তো ! কেমন আছ এখন ? কোথায় আছ ?

টেলিফোনে শাঁ শাঁ শব্দটা ভেসে আসল কিছুক্ষণ তারপর লাইন কেটে গেল তার মাথা ঝুলে পড়ল চেয়ারের ব্যাকরেস্টে শ্বাসকষ্টটা বেড়ে গেল এক ধাক্কায় অনেকটা  অনিরুদ্ধর চোখের সামনের রৌদ্রজ্জ্বল দিনটা পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের মতো ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল হঠাৎ

Comments

Popular posts from this blog

A stranger